ঘটনার সময়কালঃ ১১-১৫ অক্টোবর, ২০১৩।
একদম খাঁড়া নরম মাটির একটা ঢালের গা বেঁয়ে চলে যাওয়া সরু কিনার ধরে এগোচ্ছি আমরা। পাশাপাশি দু’টো পা ফেলা কোনোভাবেই সম্ভব নয় সেখানে; শরীরের ভারসাম্য রাখতে হাতের নাগালে থাকা শেকড়বাকড় আর লতানো ডালপালার সাহায্য নিতেই হচ্ছে তাই। মাটি যেহেতু বেশ নরম, শেকড়গুলোও তাই খুব একটা পোক্ত নয় - একটু বেশি টান পড়লেই ধরিত্রী মায়ের যাবতীয় মায়া ত্যাগ করে উপড়ে আসছে; হাতে ধরা ডালপালাগুলোও তেমনি পট পট করে ছিঁড়ে আসছে। এদিকে আবার পায়ের তলার নরম মাটিও খসে পড়ছে একই জায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে। কোনো কিছুর ওপরেই তাই খুব বেশি ভর না দিয়ে দ্রুত হাত-পা বদল করে এগোতে হচ্ছে। এমন সময়েই হঠাৎ আমার এক পায়ের তলার কিছুটা মাটি খসে পড়ল - টের পেলাম পা হড়কে দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে।
একদম খাঁড়া নরম মাটির একটা ঢালের গা বেঁয়ে চলে যাওয়া সরু কিনার ধরে এগোচ্ছি আমরা। পাশাপাশি দু’টো পা ফেলা কোনোভাবেই সম্ভব নয় সেখানে; শরীরের ভারসাম্য রাখতে হাতের নাগালে থাকা শেকড়বাকড় আর লতানো ডালপালার সাহায্য নিতেই হচ্ছে তাই। মাটি যেহেতু বেশ নরম, শেকড়গুলোও তাই খুব একটা পোক্ত নয় - একটু বেশি টান পড়লেই ধরিত্রী মায়ের যাবতীয় মায়া ত্যাগ করে উপড়ে আসছে; হাতে ধরা ডালপালাগুলোও তেমনি পট পট করে ছিঁড়ে আসছে। এদিকে আবার পায়ের তলার নরম মাটিও খসে পড়ছে একই জায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে। কোনো কিছুর ওপরেই তাই খুব বেশি ভর না দিয়ে দ্রুত হাত-পা বদল করে এগোতে হচ্ছে। এমন সময়েই হঠাৎ আমার এক পায়ের তলার কিছুটা মাটি খসে পড়ল - টের পেলাম পা হড়কে দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে।
স্বাভাবিক রিফ্লেক্সবশতই হাতে ধরে থাকা
শেকড়-ডালে বেশ জোরে টান পড়ল। পরের ঘটনাগুলো সব মুহূর্তের ভেতরে ঘটে গেল। চোখের
সামনেই দেখলাম ডানহাতে ধরা ডালটা মড়াৎ করে ভাঙছে। এদিকে পা হড়কে নিচে নেমে যাওয়ায়
হাতেও আচমকা হ্যাঁচকা টান লেগেছে; টের পেলাম কাঁধ আর হাতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে
গেল। প্রচণ্ড ব্যাথায় কাতর আর্তনাদ বেরিয়ে এল আমার মুখ দিয়ে। ওই মড়াৎ শব্দটা যে
কতটুকু ডাল ভাঙার আর কতটা অস্থিমাংস নড়ে যাবার সেটা বুঝে ওঠার আগেই শক্ত মাটিতে পা
ঠেকল। ব্যাথায় বিবশ হয়ে খেয়াল করলাম হাতটা আবার আগের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে এইটুকু
সময়ের ভেতরেই!
অসহ্য ব্যাথা কিন্তু থামার উপায় নেই সেখানে
- নরম মাটি আবার কখন কোন জায়গায় খসে পড়ে কে জানে! ব্যাথাটাকে সঙ্গী করেই এগোলাম। কিছুটা সামনেই ঝিরিপথে নামল ট্রেইল। বেশ চওড়ামত একটা
জায়গায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল দলের সবাই। একদম পেছনে ছিলাম আমি আর আনাস। দলের
বাকি চারজন - মাহবুব, ট্রেকার দম্পতি জনি ভাই-মোহনা আর আমাদের দলনেতা হিরা ভাই।
প্রচুর জোঁকের উৎপাত ট্রেইলে, সবার শরীরেই
তারা ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে অকাতরে, প্রবলভাবে। কোথাও থামলেই তাই
প্রথমেই সবাই শরীরে জোঁকের তত্ত্বতালাশ করে নিচ্ছি। যথারীতি এবারেও
কাউকে নিরাশ করেনি জোঁকেরা। মোহনার হাঁটুর কিছুটা ওপরে একটা জোঁক বহুক্ষণ ধরে রক্ত
চুষে ঢোল হয়েছে। ছাড়ানোর পরেও কিছুতেই রক্তক্ষরণ বন্ধ
হচ্ছিল না; রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর প্যান্ট। ভালোমত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেয়া
হল জায়গাটা।
এই যা! এতক্ষণেও আমাদের গন্তব্যের কথাটাই
বলা হয়নি! আমরা বেঁয়ে উঠছি দেশের দক্ষিণ-পূর্বে বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তরেখায়
ঠিক সীমানাপ্রাচীরের মতই অবস্থিত মোদক রেঞ্জ পাহাড়সারির শিরোমণি – মোদক মোয়াল
(৩৩৫৩ ফুট), খুব সম্ভবত বাংলাদেশের ২য় সর্বোচ্চ পাহাড়চূড়া (আনঅফিশিয়ালি)। স্থানীয়
বম ভাষায় যার নাম – জৌ ত্লাং। আনঅফিশিয়ালি বলতেই হচ্ছে কারণ সরকারিভাবে বইপুস্তকে
দেশের সর্বোচ্চ পাহাড়চূড়া এখনও পর্যন্ত কেওক্রাডং কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তাজিংডং।
তবে আমাদের দেশের রোমাঞ্চপিপাসুরা বেশ কয়েক বছর হল সেসব ভুল প্রমাণ করেছেন। বিশদ
বর্ণনায় যাব না, ইন্টারনেটে এসব তথ্য যথেষ্ট সহজলভ্য।
বান্দরবান থেকে থানচি বাসযাত্রা। সামনে অনাগত অ্যাডভেঞ্চার, দৃষ্টি সেদিকেই... |
এবারে একটু ভূমিকায় আসা যাক। আমরা শুরু করেছিলাম আজ দুপুর দু’টোর দিকে জৌ ত্লাং-এর সবচে’ কাছের গ্রাম দোলিয়ান পাড়া থেকে। সকাল সকাল রওনা দেবার কথা থাকলেও আগেরদিনের ধকল সামলে উঠতে সবারই বেশ বেলা হয়ে যায়। সেদিনটা কোনোভাবে কাটিয়ে পরদিন ভোরে রওনা দেয়া যেত কিন্তু দলের কয়েকজনের অলস বসে থাকতে ভালো না লাগায় আমরা সামিটের জন্যে বের হই। পথ দেখানোর জন্যে পাড়া থেকে আমাদের সাথে আসে দু’টো ছেলে। তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী পাড়া থেকে সামিট করতে সময় লাগার কথা ৩ ঘন্টা। আমরা কিছুটা সময় বাড়তি ধরে যাওয়া-আসার একটা খসড়া আন্দাজ করে নেই। সামিট করতে সন্ধ্যা হয়ে গেলেও রাতে ট্রেক করে ফিরে আসা যাবে কিংবা তেমন মনে করলে রাতটা পথেই কোথাও কাটানো যেতে পারে। সেই হিসেবে পাড়া থেকে দু’টো মুরগি আর দু’বেলা খাবার মত চাল নেয়া হল। কিন্তু আমাদের এই আন্দাজে একটা বড় ফাঁক রয়ে যায়। তারই বিনিময়ে লাভ করা সব অভিজ্ঞতার গল্পই বলার চেষ্টা করব এখানে।
আগের রাতে দোলিয়ান পাড়া পৌঁছতে আমাদের রাত
প্রায় ১২:৩০ বেজে যায়। কারবারির ভাইয়ের বাড়িতে থাকার বন্দোবস্ত শেষে রান্নাবান্না
করে খেয়ে শুতে প্রায় ৩:৩০। পরদিন বেলা করে কে কীভাবে নাক ডাকলো সেটা
দেখার জন্য আর কেউ জেগে থাকতে পারেনি।
বাড়ির পোষা বিড়াল স্বাগত জানাচ্ছে আরেকটি সকালকে। পেছনে দরজার ফাঁকে মোদক মোয়াল (জৌ ত্লাং) উঁকি দিচ্ছে। |
আমার ঘুম ভাঙল সকাল আটটার এর দিকে। প্রাতঃকর্ম সারতে ঘর থেকে বের হয়েই থ মেরে গেলাম। গ্রামটা তো উঁচুই আর এই বাড়িটাও গ্রামের সবচে’ উঁচু বাড়ি। বাড়ির পাশেই জঙ্গলে ঢাকা গভীর খাদ নেমে গেছে। তারপরেই ঘন সবুজে ছাওয়া মোদক রেঞ্জ উঠে মিশে গেছে দিগন্তে। বাড়ির পেছনের বারান্দা থেকে জৌ ত্লাং দৃশ্যমান। রাতের অন্ধকারে বোঝার উপায় ছিল না কিন্তু এখন দিনের আলোতে মনে হচ্ছিল আমি আসলে এই পৃথিবীতে নেই। তখনও জৌ ত্লাং টপকে সূর্যের আলো সরাসরি গ্রামে পড়তে পারেনি। মোদক রেঞ্জটা যদ্দূর দেখা যায়, পুরোটাই আবছা মেঘ-কুয়াশায় ঢেকে আছে। একসাথে এত সুন্দর এই প্রথম চাক্ষুষ করলাম। অপার্থিব শ্বাসরুদ্ধকর সেই সৌন্দর্য্য; জীবনভর কী-বোর্ডে মাথা ঠুকে মরলেও বর্ণনা করতে পারব না! বেশ কিছুক্ষণ হাঁ করে গিললাম চারদিক, সম্বিৎ ফিরলে ফোনটা বের করে কয়েকটা ছবি তুলে সব ধরে রাখার বৃথা চেষ্টা করলাম।
বাড়ির পেছনেই ভোরের মেঘ-কুয়াশায় ঢাকা মোদক রেঞ্জ পাহাড়সারি |
সবাই জেগে উঠেছে এই ফাঁকে। হিরা ভাইয়ের পরামর্শে জনি ভাই, মাহবুব আর আমি স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পে গেলাম চেহারা দেখিয়ে আসতে।
বিজিবি ক্যাম্প থেকে ফেরার পথে |
বিজিবি ক্যাম্প থেকে ফেরার পথে |
ফিরে দেখি হিরা ভাই কারবারি লারিং’দার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। বাচ্চাকাচ্চাসহ প্রচুর উৎসাহী দর্শক বাড়িতে ভিড় জমিয়েছে আমাদের দেখার জন্য। জানা গেল, গত প্রায় তিন বছরের মধ্যে আমরা ছাড়া কোনো বাঙালি ট্যুরিস্ট ওদিকে আর আসেনি। লারিং’দা জানালেন এর আগে আরও দু’টো দল জৌ ত্লাং চূড়ায় গেছে। জনি ভাই বললেন ওনার পরিচিত বিজয়’দার কথা, যিনি সম্ভবত প্রথম বাঙালি হিসেবে জৌ ত্লাং সামিট করেছেন ২০০৫-এ। বিজয়'দার পুরো নাম বিজয় শঙ্কর কর। জনি ভাইয়ের মাধ্যমেই পরে তার সাথে আমার যোগাযোগ হয়। স্কাইপিতে দীর্ঘ কথোপকথনে তিনি ২০০৫ সালে তাদের সেই যাত্রার গল্প করেন। শুনতে শুনতে বেশ বুঝতে পারছিলাম কতটা নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছেন তিনি। বিজয়'দা সেবার গিয়েছিলেন জনাব সুব্রত দাস নিতিশ-এর সাথে। দু'জনেই একই চূড়ায় আবারও ফিরে গেছেন ২০০৭-এ। পেশায় ডাক্তার বিজয়'দা বর্তমানে সপরিবারে কানাডাপ্রবাসী। অন্যদিকে নিতিশ'দা দেশেই আছেন আর এখনও ঘুরে বেড়ান সময় পেলেই।
দ্বিতীয় দল হিসেবে আমরা বাংলাট্রেকের দলটার কথা জানি; এই অভিযান শেষে ফেরার পথেই থানচি-বান্দরবান রুটে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান সেই দলের দু’জন সদস্য - মুগ্ধ আর সুজন।
মেঘে ঢাকা মোদক রেঞ্জ শিরোমণি – মোদক মোয়াল (জৌ ত্লাং)। সবচে’ কাছের গ্রাম দোলিয়ান পাড়ার এই বাড়িতেই ছিলাম আমরা। |
দোলিয়ান পাড়া থেকে দেখা আশপাশ। বাঁয়ে সুউচ্চ মোদক রেঞ্জ। |
আগেই বলে নেই, গুগল আর্থে জৌ ত্লাং-এর আশপাশ দেখে আমরা ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি ট্রেইলটা এতটা বুনো হতে পারে। যদ্দূর মনে আছে পাড়া থেকে জৌ ত্লাং-এর পাদদেশে যাবার জন্য একটা ছোটোখাটো পাহাড় ডিঙিয়ে আরেকটা পাহাড় খানিকটা উঠে বাইপাস করে যেতে হয়। এরপর ঝিরিপথের শুরু।
মোদক মোয়ালের পাদদেশে ঝিরিপথের ট্রেইলে; চলে আসবার পরেও আমাদের স্বপ্নে যা ফিরে এসেছে বহুবার। ছবি – মাহবুব। |
যতই ওপরে উঠছি, ঝিরিপথের পাথরগুলোও আকারে বাড়ছে। ঝিরিপথের স্বাভাবিক ধর্ম মেনে পানিতে ডুবোচরের মত উঁকি দেয়া নুড়িপাথরের বেড থেকে শুরু করে সোফার কুশন আকারের পাথর হয়ে এখন সেগুলো এখন দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে দুই-আড়াই মানুষ সমান বোল্ডারের আকার নিয়েছে। যথেষ্ট সময় নিয়ে সেসব ডিঙোতে হচ্ছে একের পর এক।
বেলা শেষের আলোয় যেন আরও দুর্গম আর রহস্যময় লাগছিল ঝিরিপথ। ছবি – মাহবুব। |
অনেক জায়গাতেই বিরাট সব গাছের গুঁড়ি প্রায় আটকে দিয়েছে পথ, কবেকার কোন ঝড়তুফানে উপড়ে যাবার সাক্ষ্য বহন করছে সেসব। তারপরে শুরু হল লম্বা ঢালু পাথুরে সব স্ল্যাব, পানি পড়ছে সেগুলোর গা বেঁয়ে। জায়গায় জায়গায় পিচ্ছিল সেগুলো - অখন্ড মনযোগ ধরে রেখে স্টেপ নিতে হচ্ছে তাই। বহু জায়গায় চার হাতপা-ই কাজে লাগাতে হল। পাথরের সাথে পাল্লা দিয়ে দু’পাশের জঙ্গলও সেইসাথে আরও উঁচু, ঘন হয়ে আসছে। কিছু কিছু জায়গায় ট্রেইল এতই খাঁড়া, পিচ্ছিল বা দুর্গম হয়ে উঠছে যে পাশের জঙ্গল দিয়ে উঠে ঝিরিপথ বাইপাস করে কিছুটা সামনে গিয়ে আবার ঝিরিপথে নামতে হচ্ছে। এমন এক বাইপাস করতে গিয়েই ব্যাথা পেলাম, শুরুতেই যেটা বলেছি।
এত ব্যাথা করছিল যে ডান হাত শক্ত করে মুঠো
পর্যন্ত করতে পারছিলাম না। অনেকটাই দমে গেলাম। ভাবছিলাম সামিট করব না। এমন বুনো
ট্রেইলে চার হাত-পা ঠিক থাকা খুবই জরুরি। ঝিরিপথ বেঁয়ে এতক্ষণ যেটুকু উঠেছি, এই
অকেজো হাত নিয়ে সেটুকুই বা নামতে পারব কি না ভেবে কুলকিনারা করতে পারছিলাম না।
একসময় উপলব্ধি করলাম এই জঙ্গলে টিকে থাকতে
হলে দমে গেলে চলবে না কিছুতেই। মন শক্ত করে তাই শুধুই পথের দিকে নজর দিলাম। ধীরে
ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক, সন্ধ্যা নামছে পাহাড়ে। টর্চ/হেডলাইট বের করলাম
সবাই। কৃত্রিম আলোতে বেশ কয়েকটা লম্বা ঢালু পাথুরে স্ল্যাব বেঁয়ে উঠলাম। এই জায়গাগুলোতে চার হাতপা-ই দরকার। কিভাবে যে দমবন্ধ করে ডান হাতটা
বাঁচিয়ে উঠছিলাম তা বলে বোঝানো যাবে না। এমন সময় একটা জায়গায় আমি আর আনাস আটকে
গেলাম।
কিছুটা সামনে থাকা আনাস চেঁচিয়ে আরও সামনে
থাকা হিরা ভাইদের ডাকছে পথের দিশা পাবার জন্য। ততক্ষণে বাকিরা সবাই সামনের ঢাল
বেঁয়ে উঠে আবার ওপারে নিচুমত একটা জায়গায় নেমে গেছে। এদিকে ঝিরির পানির শব্দে
আনাসের চিৎকার ওপারে যাচ্ছে না। প্রায় ৪৫ ডিগ্রীমত খাঁড়া নরম মাটির এক ঢাল বেঁয়ে
ক্রল করে উঠছিলাম আমরা। নিচেই লম্বা ঢালু পাথুরে স্ল্যাব যেটা একটু আগেই চার হাতপায়ে ভর দিয়ে উঠতে
হয়েছে। দু’টো
হাতই ব্যস্ত থাকায় দাঁত দিয়ে কামড়ে টর্চ ধরে আছি। ওপাশ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে
আনাস নিজেই দেখেশুনে ধীরে ধীরে ঢাল বেঁয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে শুনতে পেলাম। হঠাৎ শব্দ
শুনে বুঝলাম ভারি কোনো পাথর দ্রুত গড়িয়ে নিচে আসছে। কোনো উপায় ছিল না সরে যাবার,
ঝটপট মাথা নিচু করে ফেললাম। মুহূর্তের ভেতরে ছোটোখাটো জাম্বুরা সাইজের একটা পাথর
ঠিক মাথার তালুতে এসে বাড়ি খেল। আক্ষরিক অর্থেই চোখে সর্ষে ফুল দেখেছিলাম কয়েকটা
সেকেন্ড! চুপচাপ ব্যাথাটা হজম করে আবার ওঠায় মনযোগ দিলাম। নরম মাটি ঝুরো ঝুরো হয়ে
যাচ্ছে হাতপায়ের চাপে কিন্তু উঠতে তো পারছিই না, আরো নিচে নেমে যাচ্ছিলাম। পতন ঠেকাতে শক্ত করে মাটি
ধরার চেষ্টা করতেই দ্বিতীয়বারের মত সেদিন হাত আর কাঁধ সংযোগবিচ্ছিন্ন হল আমার।
ইলেক্ট্রিক শক লাগার মত
অনুভূতি! আমার মুখ থেকে গুঙিয়ে ওঠার আওয়াজ পেয়ে আমাদের সাথে দোলিয়ান পাড়া থেকে আসা
ছেলেটা একলাফে সামনে চলে এল। আমার অবস্থা দেখে দ্রুতহাতে দা দিয়ে মাটি কুপিয়ে
কয়েকটা ধাপ বানিয়ে দিল সে। ততক্ষণে আমার হাতটা আবার জায়গামত এসে বসেছে।
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে সদ্য কাটা ধাপগুলোতে
হাতপা দিয়ে বেঁয়ে কোনোমতে উঠতে পারলাম ওই ঢাল। এরপরে নিচে নেমে ঝিরিপথে একটু সামনে
এগিয়েই সে রাতে ক্যাম্প করলাম আমরা। ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় ছয়টা পার হয়ে গেছে। ততক্ষণে আমরা বুঝে গেছি
পাড়া থেকে আসা ছেলেদুটোর হিসেবে তিনঘণ্টায় সামিট আর আমাদের আন্দাজে কি ব্যাপক
গরমিল হয়েছে!
ঝিরির বাঁকে সামান্য উচুতে ঢালুমত এক জংলা
জায়গা ন্যাড়া করে তেরপল পাতা হল। ঝিরির স্রোত এখানে ভালোই। দু’পাশেই খাঁড়া ঢাল,
ভেঙে পড়তেই পারে মাথায়। জায়গাটাও স্যাঁতস্যাঁতে, সাধারণ অবস্থায় ক্যাম্প করার
উপযোগী কোনোভাবেই নয় তবে ওই অবস্থায় ওখানে এরচে’ ভালো জায়গা আর ছিল না। আগুন ধরাবার
উপযোগী শুকনো জ্বালানীকাঠ সেখানে দুষ্কর। বহু সাধ্যসাধনা করে আগুন জ্বালানো হল।
দেখা গেল, হাতব্যাগে নিয়ে আসা দু’টো মুরগীর একটা মারা গেছে; কেউ বলতে পারবে না
কখন। জ্ব্যান্তটাকে রেখে মরাটাই কেটেকুটে রান্নার যোগাড় চলল। আধভেজা কাঠে জ্বালা
আগুনে প্রচুর সময় লাগল মুরগি রান্না হতে। এরপরে ভাত রাঁধতে গিয়েই বাঁধল বিপত্তি। আগুনে
পর্যাপ্ত তাপ না থাকায় কিছুতেই চাল সেদ্ধ হচ্ছে না। দীর্ঘক্ষণ চেষ্টার পরেও কোনো
লাভ হল না। একসময় দেখা গেল আগুনটাই নিভতে বসেছে তবুও চাল ফুটে ভাত হচ্ছে না! অগত্যা
রণেভঙ্গ দিয়ে ওই চাল দিয়েই খেতে বসা হল।
কোনো প্লেট নেই। নদীপথে থানচি-রেমাক্রি
আসার সময় পানির ছাঁট বাঁচবার জন্যে কেনা লম্বা নীল পলিথিন কাজে লাগল এবার।
পলিথিনগুলো পাশ থেকে কেটে চাদরের মত বিছানো হল তেরপলের ওপর। তার চারদিক ঘিরে বসলাম
সবাই। সবার সামনে ভাত মানে চালের দলা বাড়া হল। কিন্তু মুরগীর ঝোল নিয়ে বাঁধল
বিপত্তি। ঢালু জায়গায় পলিথিন বেঁয়ে বারবার ঝোল পড়ে যেতে নেয় আর কচু পাতায় বৃষ্টির
পানির ফোঁটা নিয়ে খেলবার মত বারবার পলিথিনের কোনাটা আমরা উঁচু করে ধরি। এত
দূর্যোগের ভেতরেও এই নিয়ে বেশ একচোট হাসাহাসি হল। প্রচণ্ড ক্ষিধে নিয়েও দু-তিন
গালের বেশি খেতে পারলাম না, ‘চাল’ কোনোভাবেই গলা দিয়ে নামছিল না। শুধু মাংস গিলেই
সন্তুষ্ট থাকতে হল। দেখলাম পাহাড়ি ছেলেদুটো ছাড়া সবারই কমবেশি আমার মতই অবস্থা।
সেই চালই বুভুক্ষের মত গিলল ওরা।
অনিশ্চয়তার এক রাত। জীবনে অনেকরকম
অনিশ্চিত অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি তবে এমন অবস্থা একেবারেই নতুন। আমি ছাড়া বাকিরা
সবাই সুস্থ, পরদিনের ভেতরে কিভাবে সামিট করে ফিরে যাওয়া হবে তাই নিয়ে টুকটাক কথা
চলছিল। এদিকে অনেক কিছু ভীড় করছিল আমার মনে। দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গলে অকেজো হাত নিয়ে
আটকে গেছি। এই অবস্থায় ফিরে যেতেও আমার যেখানে অন্যদের সাহায্য লাগবে, সেখানে এমন ঝুঁকিপূর্ণ পাথুরে ঝিরিপথ বেঁয়ে সামিটের কথা ভাবাটা নিজের জন্য খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী
মনে হচ্ছিল। সাথে আসা পাহাড়ি ছেলেদুটোর মত গ্রামের কারবারিও
বলেছিলেন গ্রাম থেকে তিনঘন্টায় সামিট করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে গ্রাম থেকে এ পর্যন্ত
আসতেই তিনঘণ্টার বেশি লেগে গেছে আমাদের। স্পষ্টতই ওদের কথা আমাদের হিসেবের সাথে
মিলছে না। জায়গাটা এতই জংলা যে ওপরে তাকালেও ঠিকমত আকাশ দেখা যাচ্ছে না; জঙ্গল
ছাপিয়ে অনেক ওপরে মনে হচ্ছিল আকাশটাকে। এত গভীর জঙ্গলে ফোনের জিপিএস-এও
স্যাটেলাইট ধরছে না। সব মিলিয়ে সামিট থেকে কতদূরে আছি আর সামিট করতেই বা কতক্ষণ
লাগতে পারে তা পুরোপুরি ধারণা করা সম্ভব হয়ে উঠছিল না কিছুতেই।
তেরপলের চারদিকে লবণের ব্যারিকেড দিয়ে
জোঁক থেকে বাঁচার বুদ্ধি করা হয়েছে। তবে পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ থেকে রেহাই নেই।
ঝিরিতে কোমর পানি ডিঙ্গোতে হয়েছে অনেক জায়গায়; সবার গায়ের কাপড়ই ভেজা তাই - মরা
আগুনে অনেক কসরত করেও শুকায়নি সেসব।
শরতের রাত কিন্তু কাঁপুনি দেয়া শীত জঙ্গলে। কারো কাছেই বাড়তি
জামাকাপড় নেই। একটু উষ্ণতার জন্য ঠাসাঠাসি করে শুয়েছি সবাই; তেমন লাভ অবশ্য হচ্ছিল না তাতে। ব্যাগে বাড়তি মোজা ছিল, সেটা পরে বড় একটা পলিব্যাগের ভেতর দু’পা ভরে
ফেললাম। জায়গাটা ঢালু হবার কারণে স্থির থাকতে পারছিলাম না, ধীরে ধীরে পিছলে মাটিতে
ছিটানো লবণের ওপরে নেমে যাচ্ছিলাম বারবার।
জঙ্গলের তাজা অক্সিজেন পুড়িয়ে মরা আগুনটা আরও
কিছুক্ষণ বেঁচে থাকবার বৃথা চেষ্টা করে নিবে গেল একসময়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে
গেলাম আমরা। আগুন নেবার সাথে অনিশ্চয়তাও পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেল যেন অনেকগুণ। ঘুম নেই, টুকটাক গল্প করে কাটছে লম্বা একেকটা
মুহুর্ত। অনেকক্ষণ কেটে যাবার পরে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখা গেল দশ-পনের মিনিট পেরিয়েছে
মাত্র! ঘড়ি দেখা বাদ দিলাম আমরা। অনন্তকাল লম্বা মনে হচ্ছিল রাতটা।
চিৎকার করে কথা বলছিল কে যেন! চোখ মেলে
দেখি হেঁড়ে গলায় সর্বশক্তিতে গান ধরেছেন হিরা ভাই – “আশা ছিল মনে মনে!” ভোর নেমেছে
কুয়াশাঘেরা জঙ্গলে। মৃদু আলোতে রহস্যময় লাগছে আশপাশ। রাতের মরা চুলোতে নুডলস
রান্না হচ্ছে। খুব বেশি খাবার সাথে ছিল না, আগেই বলেছি। কিছুটা সামিটের জন্য রেখে
বাকিটা সবার ভাগে দু’চামচ মত পড়ল।
শুধুমাত্র সামিটের জন্য দরকারি জিনিসপত্র
নিয়ে বাকিসব এখানেই রেখে যাওয়া হবে। সবাইকে জানালাম আর এগোব না বলে ঠিক করেছি।
এদিকে মোহনাও আর এই বুনো ট্রেইলে সামনে যাবার ঠিক সাহস করে উঠতে পারছিল না। বললাম,
আমরা দু’জন নাহয় এখানেই থেকে বাকিদের জন্য অপেক্ষা করব।
সবাই চুপ। স্পষ্টতই আমি আর মোহনা একা
পাড়ায় ফিরে যেতে পারব না। আর এমন জায়গায় আমাদের
রেখে যেতেও বাকিদের মন ঠিক সায় দিচ্ছিল না। একটু ভেবে হিরা ভাই বললেন, “তোরা আর
সামনে না যেতে চাইলে কেউ জোর করবে না। কিন্তু এমন জঙ্গলে সারাদিন এক জায়গায় বসে
থাকাও খুব একটা বুদ্ধিমানের হবে না। আর তোরা যদি না যেতে চাস তাহলে আমরা কেউই আর
যাব না। গেলে সবাই যাব, নাহয় কেউই যাব না।“
উভয় সংকটে পড়লাম। কি বলব ভাবছিলাম, এর
ভেতরেই তিনি মোহনাকে রাজি করিয়ে ফেললেন। সবাই এবার আমার দিকে তাকিয়ে। ভেবেই
পাচ্ছিলাম না কি করব। সবাই ততক্ষণে পুরোপুরি তৈরি, সঙ্কেত পাওয়ামাত্র হাঁটা শুরু
করবে। আমি তখনও দ্বিধান্বিত।
হিরা ভাই আশ্বাস দিয়ে বললেন, “প্রতিটা
মুহূর্ত আমি তোর পাশে থাকব, কিচ্ছু হবে না তোর।“ তবুও ঠিক সাহস পাচ্ছিলাম না। একটু
চুপ থেকে হিরা ভাই বললেন, “সবাই এগোও, মিলন আমাদের সাথে যাবে।“ হাততালি দিয়ে উঠল
সবাই। তখনও আমি মনস্থির করে উঠতে পারিনি। তবুও কি ভেবে যে সবার সাথে এগোলাম তা আজও
ভেবে পাইনি।
ওপরের ট্রেইল আরও খাঁড়া হল সময়ের সাথে
পাল্লা দিয়ে। অনেকটা পথ উঠতে হল বালিশ আকারের শুকনো
পাথর বিছানো ঝিরিপথে। বর্ষায় ওই জায়গাগুলোর ধারেকাছে যাবার কথাও চিন্তা করা যাবে
না। একেবারে পেছনে আমি আর হিরা ভাই। আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি থাকায় আমার অনেক সময়
লাগছিল। একেকটা পাথরের ওপর আগে এক পা ভালো করে দাবিয়ে
খুব দেখেশুনে উঠছিলাম। হিরা ভাই তাই দেখে আমার বাম হাতটা মুঠোয় নিয়ে আগে আগে
উঠছিলেন। কোনোদিকে না তাকিয়ে অন্ধের মত অনেকটা পথ শুধু ওনার স্টেপগুলোই ফলো করে
গেলাম। এমন ঢালু পাথুরে ট্রেইলে এভাবে কাউকে টেনে নিয়ে যাওয়া মুখের কথা নয়। খুব
অবাক হচ্ছিলাম ভাইয়ের স্ট্যামিনা দেখে। ওনার ওপর শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা বেড়ে গেল
বহুগুণ।
বেশ অনেক জায়গাতেই দড়ির সাহায্য নিতে হল।
শক্তপোক্ত কোন গাছের সাথে দড়ি বেঁধে তরতরিয়ে উঠে যাওয়া গেল কঠিন সেসব জায়গা। পথের যেন শেষ নেই। চারদিকের ভয়ংকর বুনো সৌন্দর্য্যে পুরোপুরি বুঁদ
হবার উপায় নেই, সাবধানে না চললে ঘটে যেতে পারে বড় কোনো দূর্ঘটনা। একখানে ক্রল করে
উঠতে গিয়ে মৌমাছির কামড় খেলেন জনি ভাই; ছোটোখাটো এক মৌচাকের পাশ দিয়ে যাওয়া ছাড়া
উপায় ছিল না সেখানে। খুব ভয়ে ভয়ে পার হলাম পেছনে থাকা আমরা কয়েকজন, ভাগ্যিস আর
কোনো মৌমাছি এল না!
নড়বড়ে পাথরে ভরা লম্বা ভীতিকর এক জায়গা
পাড়ি দিতে গিয়ে ওপর থেকে গড়িয়ে আসা এক পাথরে পা চাপা পড়ে ভালোরকম ব্যাথা পেল আনাস।
পাথুরে ঝিরিপথটা শেষই হতে চাইছিল না। সাথে আসা ছেলেদুটো শুধু বলছিল এইতো আরেকটু
সামনেই ঝিরি শেষ, এরপর অল্প উঠলেই চূড়া। আগের দিনই ওদের সাথে আমাদের হিসেবের ফারাক
বুঝে গেছি। আজকে তাই এসব শুনে আর ভরসা পাচ্ছিলাম না।
একসময় লম্বা ঢালু সব পাথুরে স্ল্যাব বেঁয়ে
উঠতে হচ্ছিল। পেছনে ফেলে আসা স্ল্যাবগুলোর মত নয় সেসব; এগুলো আকারে আরও চওড়া, খাঁড়া পিচ্ছিল আর
এবড়ো থেবড়ো। অনেকখানেই বিপজ্জনক আলগা পাথর, ধাক্কা লেগে নিচে থাকা কারো ওপরে পড়তে
পারে কিংবা নিজেই সেসবে ফস্কে গিয়ে ঘটতে পারে দূর্ঘটনা। কোথাও দু’পাশে গাছের
ডালপালা ধরে ওঠা গেছে, কোথাওবা ধরার মত কিছুই নেই। পাথরের খাঁজে খাঁজে হাত পা আটকে
উঠতে হয়েছে; এদিকওদিক হলেই পিংপং বলের মত টুইং-টুইং করে এক্কেবারে নিচে গিয়ে পড়তে
হবে। এক জায়গায় বেশ বড় একটা আলগা পাথর ফেলে দেয়া হল, ফেরার সময় যাতে বিপদে না পড়তে
হয়। স্পষ্ট
মনে আছে অন্তত ছয়-সাত সেকেন্ড ধরে গড়িয়ে নিচে পড়ল সেটা, প্রত্যেকবার গড়ান খেয়ে
ভাঙছিল একটু একটু করে। নিঃশব্দ জঙ্গল কেঁপে উঠছিল প্রচণ্ড সেই শব্দে।
পাথুরে ট্রেইলটা শেষ হতেই চাইছিল না।
একেকটা বাঁক নিয়ে দেখি সামনে আবার একইরকম লম্বা পথ। বহুক্ষণ পরে ঝিরির উৎসে
পৌঁছলাম একসময়। একটা পাথরের ভেতর থেকে ফোটায় ফোটায় চুইয়ে পানি পড়ছে। উৎস বলাটা ঠিক
হল কি না জানি না কারণ পাথরের ওপাশটা দেখার উপায় ছিল না। এরপরে আর পানি নেই, বোতল
সব ভরে নেয়া হল।
এরপর বাঁক নিয়ে উঠে উঁচু সব গাছের জঙ্গলে
পড়ল ট্রেইল। এত ওপরে উঠেও আকাশটা আগের মতই দূরে মনে হচ্ছিল। আরও খানিক ওপরে
শুরু হল উঁচু ঘন বাঁশের জঙ্গল। এতই ঘন যে সূর্যালোক সেখানে ঢুকতে পারে
না বললেই চলে - ছমছমে পরিবেশ। বাঁশগাছ পচে মাটিতে মিশছে, তাতেই আবার জন্মাচ্ছে –
বছরের পর বছর, স্তরের ওপরে স্তর। পায়ের নিচে তাই স্যাঁতস্যাঁতে, থকথকে কাদা -
কব্জি অব্দি দেবে যাচ্ছে। পা কাটল কয়েকজনের। আমি স্যান্ডেল পরে ছিলাম, খাঁজকাটা সোলটা অল্পক্ষণেই ইঞ্চিখানেক পুরু
কাদায় সমান হয়ে গেল। পায়ের পাতা আর স্যান্ডেলের মাঝের ফাঁকেও কাদা ঢুকে পিছলে যাচ্ছি। পা চালানোই মুশকিল হয়ে উঠল। বারবার পিছলে নেমে
যাচ্ছিলাম। বাঁশ ধরে পতন ঠেকাতে গেলে বাঁশের গায়ে থাকা সূক্ষ্ম রোঁয়া ফুটে যাচ্ছিল
হাতের তালুময়। হাতমুখ সবখানেই রোঁয়া ফুটে গেল। রোঁয়াগুলো এতই সূক্ষ্ম যে টিশার্টের
ওপর দিয়েও গায়ে ফুটছিল। হাত দিয়ে মুখ-গলা-ঘাড়ের ঘাম মুছতে গেলেই ঘষা খেয়ে জ্বালা
করছিল রোঁয়াময় জায়গাগুলো।
পুরো জায়গাটাই জোঁকের আখড়া; মুহুর্তটুকু
দাঁড়ালেও জোঁক লাফিয়ে উঠছিল পায়ে। অনন্তকাল ধরে উঠছি যেন, অধৈর্য্যের চূড়ান্ত
সীমায় গেছি সবাই। জঙ্গলে বারবার হারিয়ে ফেলছিলাম সামনে থাকা পাহাড়ি ছেলেটাকে, ডাক
দিয়ে ওর শব্দ ধরে খুঁজে নিচ্ছিলাম পথ। একসময় ছেলেটা বলল, “চলে এসেছি!”
একটুখানি সমতল জায়গাজুড়ে কোনো গাছ নেই।
তবে চারদিকে আগের মতই বাঁশের জঙ্গল। এমনিতে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। তবে ফোনের
জিপিএস রিডিং বলছে আমরা পৌঁছেছি জায়গামতই। বহুদিন পরে আকাশটা যেন একটু কাছে মনে
হচ্ছিল। ঘড়িতে ঠিক দুপুর দু’টো বাজছে তখন।
একদিকের কিছু বাঁশ কেটে ফেলতেই দেখা গেল
ওপাশে ঢাল নেমে গেছে নিচে। দূরে উঁচু উঁচু সব পাহাড়সাড়ি। মায়ানমার!
জৌ ত্লাং-এর চূড়ায়। ওপাশে মায়ানমার। ছবি – আনাস। |
দেশের সর্বপূবের দুর্গম সুউচ্চ এই প্রান্তে অদ্ভূত অবর্ণনীয় এক অনুভূতির সাথে পরিচয় হল আমার। নতুন জীবন পেলাম যেন আজ। এমন রুদ্ধশ্বাস সব মুহুর্ত শেষে বুকভর্তি তাজা বাতাসের নেশাতুর অনুভূতির জন্যেই বুঝি এই মানবজন্ম...
ফিরতি ট্রেইলে দোলিয়ান পাড়া থেকে রেমাক্রি। ছবি - আনাস। |
ফিরতি ট্রেইলে দোলিয়ান পাড়া থেকে রেমাক্রি |
সাঙ্গুর বুক চিরে ফিরে চলা - রেমাক্রি থেকে থানচি |
ডুবোপাথরে বৈঠা ঠেকিয়ে পথ করে নিচ্ছেন মাঝির সাগরেদ। সতর্ক না থাকলেই ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। |
আমাদের যাত্রাপথ। A –
বান্দরবান, B – থানচি, C –
রেমাক্রি, D – দোলিয়ান পাড়া এবং E - জৌ ত্লাং। ছবি – গুগল ম্যাপস। কৃতজ্ঞতা - আনাস।
ফুটনোটঃ কৃতজ্ঞতায় নাম না থাকা ছবিগুলো লেখকের তোলা।
|