সবুজে ছাওয়া পাহাড়ঘেরা ছোট্ট শান্ত দেশ ভুটান। সহস্র শতাব্দীপ্রাচীন প্রকৃতি সেখানে হাত বুলিয়ে দেয় স্নিগ্ধ পরশে, বাতাস এসে ফিসফিসিয়ে বলে যায় সুদূর অতীতের না বলা
কোনো গল্প, প্রথম দেখাতেই মানুষেরা বরণ করে নেয় আন্তরিক
হাসিতে।
ছবি স্বত্বঃ লেখক। সময়কালঃ ডিসেম্বর ২০১৫।
থিম্পু স্তূপায় এক পূণ্যার্থী প্রেয়ার হুইল বা প্রার্থনাচক্র ঘুরাচ্ছেন। বাম হাতে ধরেছেন বিশালাকারের চক্রের হাতল আর ডান হাতে ছিল ছোট আকৃতির আরেকটি চক্র। অনুমতি চাওয়ামাত্রই সম্মতিসূচক হাসি দিলেন ওই অবস্থাতেই।
পুনাখায় দেখা পেয়েছিলাম এই দিদিমার। কোলের ব্যাগে করে গাছের শেকড়বাকড় জাতীয় কিছু
একটা বিক্রি করছিলেন তিনি। ভাষাগত ব্যবধানের জন্য কথা বলা সম্ভব হয়নি। ক্যামেরাটা
দেখিয়ে ইশারা ইঙ্গিতেই অনুমতি নিয়ে তুলতে হয়েছিল ছবিটা। পরে জেনেছিলাম এমন চোঙাকৃতি টুপি যারা পরেন, তারা উঁচু এলাকার বাসিন্দা। এই উচ্চতা কিন্তু আর্থিক
বা মর্যাদাগত নয় বরং
ভৌগলিক। এসব মানুষদের নিবাস দেশটির দুর্গম সুউচ্চ কোন এক পর্বতভূমিতে।
পুনাখার এক টুকরো নিসর্গ।
পুনাখার কোন এক পাহাড়ের
ওপর অবস্থিত স্তুপা থেকে।
পুনাখায় পাতানো ছোট্ট বন্ধু।
পুনাখা যংয়ের প্রধান ফটক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন দু’জন বৌদ্ধ ভিক্ষু।
ঘন পাইনের জঙ্গলে ঢাকা সব পাহাড়ে ঘেরা ফব্জিখা উপত্যকার একাংশের ওপর থেকে দেখা মোহনীয় সূর্যাস্ত। ডিসেম্বরের হাড়কাঁপানো শীতের এক শেষ বিকেলে কেন্দ্রীয় ভুটানের এই অঞ্চলে পৌঁছে এমন দৃশ্য দেখে বেশ কিছুক্ষণের জন্য ঠান্ডার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়। পরে হাতমোজা খুলে কয়েকবার শাটার চাপার পর খেয়াল হল আঙ্গুলে আর সাড়াই পাচ্ছিনা বলতে গেলে! পাইনের জঙ্গলে চিতা, শেয়াল, হরিণ ইত্যাদির আনাগোনা বিস্তর। শীতকালে এই উপত্যকা মুখরিত হয়ে ওঠে সুদূর তিব্বতের উচ্চভূমি থেকে আসা কালো গলার অপূর্ব সারস পাখিদের
(Black Necked Crane) কলরবে। ভুটানের রয়েল সোসাইটি ফর প্রোটেকশন অফ নেচারের উদ্যোগে ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নিকট অতীতেও বিপন্নপ্রায় এই সারসদের নিরাপদ শীতকালীন চারণভূমি হিসেবে অভূতপূর্ব পরিচিতি পেয়েছে এই উপত্যকা। ফলস্বরূপ গত কয়েকবছরে এখানে ঘুরতে আসা সারসদের সংখ্যাও বেড়ে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। স্থানঃ ফব্জিখা / গাংত্যে উপত্যকা, ভুটান।
ফব্জিখা / গাংত্যে উপত্যকায় সূর্যাস্ত।
সূর্য উঠেছে ফব্জিখা / গাংত্যে উপত্যকায়। জানালার কাঁচে গলছে রাতভর জমে বরফ হওয়া কুয়াশা।
সূর্যের উত্তাপে তখনও গলে যায়নি রাতভর জমে বরফ হয়ে যাওয়া সাদা কুয়াশার দল। ভোরবেলা গাংত্যে / ফব্জিখা উপত্যকায়।
ফব্জিখা / গাংত্যে উপত্যকার পানে।
গোল গর্তওয়ালা বিশালাকৃতির এক বাটির মত দেখতে (Bowl shaped) ফব্জিখা / গাংত্যে উপত্যকায়।
ফব্জিখা / গাংত্যে উপত্যকার পাইনের সুনসান জঙ্গলে।
ফব্জিখা / গাংত্যে উপত্যকার পাইনের জঙ্গলে।
ফব্জিখা / গাংত্যে উপত্যকার পাইনের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে।
টাইগার্স নেস্ট (তাকশাং গুম্ফা) উঠবার পথে একদন্ড জিরিয়ে
নিচ্ছেন পর্যটক।
তাকশাং গুম্ফা কিংবা টাইগার্স নেস্ট মনেস্টারি নামেও বহুল
পরিচিত এই
বৌদ্ধ মঠের অবস্থান পারো শহরের খুব কাছেই। পারো উপত্যকা থেকেও আরও প্রায় হাজার তিনেক ফিট বেশি
উচ্চতায় পাহাড়ের খাঁড়া ঢালে সুনিপুণ স্থাপত্যশৈলীতে
নির্মিত এই মঠটি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিংবদন্তি অনুযায়ী কথিত আছে যে, এক অপদেবতাকে বধ করার উদ্দেশ্যে বৌদ্ধ আধ্যাত্মিক
নেতা, গুরু
রিনপোচে, একটি বাঘিনীর পিঠে চড়ে সুদূর তিব্বত থেকে এখানে উড়ে আসেন। অপদেবতা বধের পর এই পাহাড়েরই এক গুহায় গুরু ধ্যানমগ্ন হন। এ
কারণেই পরবর্তীতে স্থানটি এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং নির্মিত হয় এই মঠ।
তাকশাং গুম্ফা যার আরেক নাম টাইগার্স নেস্ট।
টাইগার্স নেস্ট (তাকশাং গুম্ফা) থেকে
নামার পথে প্রায় মাঝবেলায়।
তাকশাং গুম্ফা থেকে নামার পথে দেখা পেলাম ছোট্ট এক মেয়ের, একমনে খেলছিল একাই। তার বাড়ি খুব সম্ভবত এই পাহাড়ের ঢালেই কোথাও।
তাকশাং গুম্ফা থেকে পাইনের জঙ্গলে নেমে আবার ফিরে চাইলাম ওপরে। অনেক ওপরে পাহাড়ের গায়ে ওই ছোট্ট সাদা ঘরটাই তাকশাং গুম্ফা।
বদ্ধ এক করিডোর পার করে এখানে ঢুকবার সাথে সাথেই অদ্ভূত ধরণের দমকা এক ঝলক বাতাস এসে লাগল চোখেমুখে। মনে হল যেন সেই পঞ্চদশ শতাব্দীর ওপার থেকে বয়ে আসা সেই হাওয়া; চোখমুখ ছুঁয়ে দিয়ে এক পরশেই বলে দিতে চাইছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমে থাকা না বলা সব হাসি-কান্না, গৌরব আর গ্লানির সাক্ষী হয়ে থাকবার কথা। অতীতে বৌদ্ধ
ভিক্ষুদের আশ্রম এবং দূর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া এমন স্থাপনাগুলো এখন সরকারের
দাপ্তরিক কাজ ছাড়াও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিভাগীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। স্থানঃ পারো যং (পঞ্চদশ শতাব্দীতে নির্মিত), পারো, ভুটান।
পারো যংয়ে ঢুকবার রাস্তা। পারো চু অর্থাৎ পারো নদীর ওপরের এই পাথুরে সেতু দিয়েই ঢুকতে হয় যংয়ের মূল ভবনের চত্ত্বরে।
পারো যংয়ের দেয়ালে বৈচিত্র্যময় চিত্রকলা।
শেষ বিকেলে পারোর রাস্তায় ঘুরতে গিয়ে দেখা হয়ে গেল প্রায় আমার দুই ভাতিঝিরই বয়সি এই দুই বান্ধবীর সাথে। শহরে ঢোকার মুখের দিকেই বসানো বিরাট সাইজের প্রেয়ার হুইলকে ঘিরে চলছিল তাদের খেলা। ছবি তোলার অনুমতি চাইতেই সানন্দে রাজি দুজনেই, ছুটোছুটি বেড়ে গেল আরও। বেশ কিছুক্ষণের জন্য আমিও হয়ে গেলাম ওদের খেলা আর দুষ্টুমির সাথী। একদম ঠিক যেন আমার দুই ভাতিঝি, ওয়ানিয়া আর জুহাইরাকেই পেয়ে গেলাম দেশ থেকে দূরে অন্য আরেক দেশে।
পারোর মূল শহরের বেশ কাছেই পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এক আবাসিক এলাকায় দেখা মিলল এই দুই ভাইবোনের। ক্যামেরা দেখে প্রথমে পাথর হয়ে গেলেও বহু সাধ্যসাধনার পরে অনেকটাই সহজ হল দু’জন। শেষদিকে তো শাটারের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে লাগল ভাইবোনের খুনসুটি আর দুষ্টুমি।
পারোর মূল শহরের বেশ কাছেই পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এক আবাসিক এলাকায় দেখা মিলল এই দুই ভাইবোনের। ক্যামেরা দেখে প্রথমে পাথর হয়ে গেলেও বহু সাধ্যসাধনার পরে অনেকটাই সহজ হল দু’জন। শেষদিকে তো শাটারের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে লাগল ভাইবোনের খুনসুটি আর দুষ্টুমি।
পারো শহরের অদূরেই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এক প্রশিক্ষণায়তনে দুপুরবেলার অবসরে শিক্ষার্থীরা পোজ দিলেন ক্যামেরার জন্য।
ভুটানের রাজধানী থিম্পুর রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে এক দোকানের ভেতর এই দিদিমার সাথে দেখা। প্রথমে তো ছবি তুলতে দেবেন না কিছুতেই। এদিকে আমার হাতে ক্যামেরা দেখে তাঁর ছোট বোন
নিজ থেকে এসে ছবি তুলে দিতে বললেন। বোনকে দেখে এরপর দিদিমাও কিছুটা নরম হলেন – মিলল অনুমতি।
দিদিমার বোন, যার ছবি তুলেছিলাম প্রথমে।
পাহাড়ি জঙ্গল থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে পিঠে বয়ে
নিয়ে যাচ্ছিলেন এই ভদ্রলোক। পাহাড়ে যেখানে
গ্যাস-বিদ্যুৎ
সুবিধা নেই, রান্নাবান্নার
কাজে সেখানে এখনও জ্বালানি কাঠই ভরসা। স্থানঃ পারো, ভুটান।
পূবের পাহাড় টপকে
থিম্পুর ওপর সূর্যের প্রথম আলোকছটা।
থিম্পুতে সকাল।
পারো থেকে থিম্পু যাবার পথে শেষ বিকেল।
পুনাখা থেকে ফব্জিখা যাবার পথে রাত কাটিয়েছিলাম মেতসিনা নামক এই ছোট্ট শহরে। চারপাশে পাহাড়ঘেরা মেতসিনা থেকে দেখা ভোর।
পুনাখার সেই স্তুপায় প্রতীকি বোধিবৃক্ষের ছায়াতলে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি।
পারো শহরের খুব কাছেই নিজেদের বাড়ির উঠোনে ছোট্ট ছেলেটি খেলছিল।
ফব্জিখা / গাংত্যে উপত্যকার শিশুরা।
ফব্জিখা / গাংত্যে উপত্যকার সন্তান।
পুনাখা যংয়ে আগত এক পূণ্যার্থী। ছবি তুলবার অনুমতি চাইতেই রাজি হলেন সানন্দেই।
পুনাখা যংয়ে প্রেয়ার হুইল (প্রার্থনাচক্র) ঘুরিয়ে যাচ্ছেন এক পূণ্যার্থী।
শেষ বিকেলে পারো উপত্যকায়।
পারোর কাছেই পাহাড়ের ওপরে ভিউপয়েন্ট থেকে। দূরে পারো এয়ারপোর্টের রানওয়ে দেখা যাচ্ছে। পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক এই আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টের চারপাশে পাহাড় ঘিরে থাকায় এখানে প্লেন ওঠানামা করানোর জন্য দরকার হয় অত্যন্ত কুশলী পাইলটের। সারা দুনিয়ার ভেতর মাত্র দশজন পাইলটেরই নাকি লাইসেন্স আছে এখানে চালানোর বলে পড়েছিলাম।
"এই শহর আমার!"
সূর্যাস্তের পরে পারোতে।
দেশে ফেরার পথে ভুটানের ওপর থেকে দেখা সূর্যোদয়। মাইলের পর মাইল পাহাড়সারির ভাঁজে ভাঁজে অপূর্ব আলোকছটার বিচ্ছুরণ। বহুদূরে নদীর পানি চমকাচ্ছে রূপালি আভায়। আমার ক্ষুদ্র জীবনে দেখা অন্যতম সেরা ভোর।